এস ডি সুব্রত
দস্যু বনহুরখ্যত লেখক রোমেনা আফাজের জন্ম ২৭ ডিসেম্বর ১৯২৬ সালে বগুড়া জেলার শেরপুরে। পিতার নাম কাজেম উদ্দীন আহম্মদ, মায়ের নাম আছিয়া খাতুন । নয় জন সন্তানের মধ্যে তিনি পরিবারের বড় সন্তান ছিলেন । মৃত্যু ১২ জুন ২০০৩ সালে। রোমেনা আফাজ বাংলা সাহিত্যের পাশে সামাজিক ক্ষেত্রেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ৩৭টি সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানে সংযুক্ত ছিলেন, যেমন: জাতীয় মহিলা সংস্থা, রেডক্রস, শিশু একাডেমী, রাইটার্স ফোরাম প্রধানত-বগুড়া শাখা । জীবনের শুরুতে কলকাতা–শেরপুর–বগুড়া প্রভৃতি স্থানে পিতার সঙ্গে ভ্রমণ করেন, যেখানে পুলিশ পরিদর্শক বাবার কাজের সাথে পরিচিত হয়ে রহস্য-গল্পে আগ্রহ গড়ে তোলে । ৯ বছর বয়সে তার লেখা ‘বাংলার চাষী’ ছড়াটি কলকাতার মোহাম্মদী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, যা ছিল তার সাহিত্যসফরের সূচনা । ১৯৪১ সালে শেরপুর থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, এরপর ১৯৪৩ সালে আজিজুল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন । রোমেনা আফাজ রচনা করেন প্রায় ২৫০টি গ্রন্থ—উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা ও রহস্য গোয়েন্দাশ্রেণীর সিরিজসহ । তাঁর অন্যতম জনপ্রিয় সিরিজ: দস্যু বনহুর সিরিজ – বাংলা সাহিত্যে ক্লাসিক গোয়েন্দা-থ্রিলারের অধিষ্ঠাতা স্মরণীয় চরিত্র । দস্যুরানী সিরিজ – নারীমুখী অ্যাডভেঞ্চার ধারার কাহিনী । সামাজিক ও প্রেমমূলক উপন্যাস: ‘দেশের মেয়ে’, ‘জানি তুমি আসবে’, ‘মায়ার সংসার’, ‘মধুমিতা’, ‘মাটির মানুষ’, ‘রক্তে আঁকা মাপ’ প্রভৃতি । দস্যু বনহুর একজন ‘রবিন হুড’–এর মত কুখ্যাত-ভালো চরিত্র ঠিকমতো ফুটিয়ে তোলেন—দরিদ্রের বন্ধু, ধনীদের শত্রু । রোমেনা আফাজের বিখ্যাত কাহিনীগুলো থেকে নির্মিত হয় নয়টি চলচ্চিত্র, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ‘কাগজের নৌকা’
(১৯৬৬), ‘মোমের আলো’ (১৯৭০), ‘মায়ার সংসার’ (১৯৭৪), ‘মধুমিতা’ (১৯৭৫), ‘মাটির মানুষ’ (১৯৯৪), পাশাপাশি ‘দস্যু বনহুর’ চরিত্রোপস্থাপনের জন্য নতুন প্রজন্মের মনোযোগ আকর্ষণ করে । তার অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেমন ‘রোমেনা আফাজ স্মৃতি পরিষদ’, ‘রোমেনা আফাজ পাঠাগার’, ‘রোমেনা আফাজ রোড’ –বগুড়ায় তার স্মরণ অম্লান রাখে । ১৯৬৫ সালে প্রথম প্রকাশ হয় তার ‘দস্যু বনহুর’। এই সিরিজ তাঁকে দারুণ জনপ্রিয়তা এনে দেয়। তাঁর পরিচিতি গড়ে ওঠে ‘দস্যু বনহুরখ্যাত রোমেনা আফাজ’ নামে। তবে তাঁর প্রথম বই হচ্ছে ‘রক্তে আঁকা ম্যাপ’। বগুড়ার ‘সাহিত্য কুঠির’নামের একটি প্রকাশনা সংস্থা ১৯৫৯ সালে বইটি প্রকাশ করে। সেটি ছিল দস্যুরানি সিরিজের প্রথম বই। ছেলে মন্তেজুর রহমান প্রথম আলোকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, রোমেনা আফাজের সিরিজ, উপন্যাস, ছোটগল্প, কাব্যগ্রন্থসহ বিভিন্ন ধরনের ২৫০টি বই প্রকাশ হয়েছে। এর মধ্যে ১৩৮টি দস্যু বনহুর সিরিজ এবং ১২টি দস্যুরানি সিরিজ। তিনি বলেন, ‘দেশে বইয়ের পাঠক সৃষ্টিতে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। মায়ের দস্যু বনহুর বই মানে ওই সময়ের অনেক পাঠকের কাছে স্মৃতির দুয়ার খুলে যাওয়া। মায়ের সঙ্গে কোথাও গেলে সেই অনুভূতির প্রকাশ দেখেছি। তাঁর সঙ্গে যেখানে যেতাম, তাঁকে ঘিরে ধরতেন লোকজন। দস্যু বনহুর পড়ে প্রতিবেশীরা বাড়ি এসে প্রশংসা করে যেতেন। নারী হয়ে রহস্য, থ্রিলার নিয়ে লেখা তাঁদের কাছে বিস্ময়ের বিষয় ছিল।’ মন্তেজুর রহমান বলেন, রোমেনা আফাজের লেখার কোনো সময় ছিল না। কাজের অবসরে নয়, তিনি কাজের ফাঁকে ফাঁকে লিখতেন। বললেন, ‘কখনো লিখতে বসে উঠে গিয়ে ভাত চড়াতেন। কত দিন শিশু আমি খাওয়ার বায়না ধরায় মা লেখা ছেড়ে উঠে খেতে দিয়েছেন! কখনো কোনো কিছুতে বিরক্ত হতেন না।’ রোমেনা আফাজের ছয়টি বই থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। ১৯৬৬ সালে ‘কাগজের নৌকা’ বইটির প্রথম চলচ্চিত্রায়ণ হয়। সেটি পরিচালনা করেন সুভাষ দত্ত। এরপর ১৯৭০ সালে ‘মোমের আলো’, ১৯৭৪ সালে ‘মায়ার সংসার’, ১৯৭৫ সালে ‘প্রিয়ার কণ্ঠস্বর’ বইটি থেকে ‘মধুমিতা’ এবং ১৯৯৪ সালে ‘মাটির মানুষ’, এই চারটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন পরিচালক মোস্তফা মেহমুদ। সবশেষ নব্বই দশকে ‘দস্যু বনহুর’ নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানা। রোমেনা আফাজের ৯ সন্তানের মধ্যে ৬ ছেলে ও ১ মেয়ে । দুই ছেলেমেয়ে বেঁচে নেই।
ছেলে মন্তেজুর রহমান বলেন, ‘প্রথম সিনেমাটি হওয়ার পর পুরো এলাকায় সাড়া পড়ে যায়। বাড়িটিকেই লোকজন বলা শুরু করে কাগজের নৌকা বাড়ি। মধুমিতা নির্মাণ হলে লোকজন আমাদের বাড়িকে মধুমিতার বাড়ি বলে ডাকা শুরু করে।’ তিনি বলেন, রোমেনা আফাজ ভক্তদের খুব মূল্যায়ন করতেন। আলমারি ভর্তি এখনো ভক্তদের চিঠি। তিনি বইয়ের পেছনে কোনো কোনো ভক্তের চিঠির উত্তর দিতেন, কারও কারও নাম উল্লেখ করতেন। ১৯৭৬ সালে মেয়ের মৃত্যুর শোকে একবার লেখালেখিতে ভাটা পড়ে। দ্বিতীয়বার তাঁর লেখায় ভাটা পড়ে ১৯৯৪ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর।
স্বাধীনতা পুরস্কার (পদোন্নত) – ২০১০ সালে, বেগম রোকেয়া স্বর্ণপদক – ২০০০ সালে, একুশে পদক ২০০৩ সালে, আরও ২৬টি সম্মাননা ও পুরস্কার লাভ। বাংলার গোয়েন্দা-থ্রিলার ধারায় নারীর লেখনী লালন করে সাহিত্যচর্চায় নতুন পথ সৃষ্টি করেছিলেন রোমেনা আফাজ ।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ।
নিলয় ১৭৪/৩ পূর্ব নতুন পাড়া, সুনামগঞ্জ।