প্রতিবেদক: HM Jakir | ক্যাটেগরি: শিল্প ও সাহিত্য | প্রকাশ: 4 Jul 2025, 12:14 AM


রাস্তার মানুষ
এইচএম জাকির
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইটের সামনে আজও গুনগুন করে গান গায় সেই ছেলে। মুখে ময়লা, গায়ে ছেঁড়া জামা, হাতে একটা পুরনো তবলা—প্লাস্টিক দিয়ে মোড়া। কাঁধে এক চিলতে লাল গামছা। টুকটাক ভিক্ষাও চায় না, বরং টেবিল পেতে গান গায়—
‘এই শহর ফেলে একদিন চলে যাবো দূরে...’
রাস্তার মানুষ। কেউ নাম জানে না, কেউ জন্ম জানে না। অথচ সে একদিন ছিল—একজনের গর্ভের মানুষ, এক প্রেমের চিহ্ন, এক প্রেমের ভগ্নাংশ!
সন্ধ্যা নেমেছে ঢাকার আকাশে। সায়মা তখন ইডেন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। রাজনীতি করত, নাটক করত, আর... প্রেম করত। প্রেমিকের নাম ছিল—আরমান। নর্থ সাউথের ছাত্র, বাবার টাকা, মায়ের দোয়া, বন্ধুরা যার চারপাশে নাচে। সায়মা সহজ মেয়ে ছিল না। তবু আরমানের সাহচর্য, একটার পর একটা ডেট, হোস্টেল ফাঁকি দিয়ে ‘রুম’ এ যাওয়া, প্রেমের ছলনায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া—সব মিলিয়ে জীবনকে সিনেমা ভাবতে শুরু করেছিল। এক সন্ধ্যায় তারা মিরপুরে এক গেস্ট হাউজে ছিল। পর্দা টেনে দেওয়া রুমের ভিতর, বাইরের শব্দ ঢোকে না, ঢোকে শুধু একে অপরের নিঃশ্বাস। সেই রাত্রির পরে জীবন আর আগের মতো থাকেনি।
সায়মা অনুভব করে শরীরে কিছু বদল। একমাস, দু’মাস, তিনমাস—মাসিক বন্ধ। ক্লিনিকে গেলে বলে—‘আপনি তিন মাসের গর্ভবতী’। চোখে অন্ধকার নেমে আসে। সে আরমানকে ফোন করে। উত্তরের বদলে পাওয়া যায় :
— ‘তুমি কি পাগল নাকি? এটা তোমার সমস্যা। আমি কাল রাতেই কানাডা যাচ্ছি!’
—‘তুমি বলেছিলে, ভালোবাসো’।
—‘ভালোবাসা আর দায়িত্ব এক জিনিস না, সায়মা। নিজে সামলাও’।
আরমান উড়াল দেয়। সায়মার পেটে জন্ম নেয়া জীবনটা ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। গর্ভের ভারে সে ক্লাস ছেড়ে দেয়। বাড়িতে কাউকে বলে না। পেটের কাপড় বড় হয়, চোখের জলের চিহ্ন ঘন হয়। শেষমেষ এক রাত্রে, হাত কামড়ে কাঁদতে কাঁদতে ধানমণ্ডির এক ক্লিনিকে সে সন্তান প্রসব করে। মেয়েটা নয়—একটি ছেলে।
সেই রাতেই নবজাতকটিকে কাপড়ে মুড়ে, বুক চেপে ধরে, সায়মা চলে আসে রায়েরবাজার বস্তির পাশে। গভীর রাত। কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে। একটা ডাস্টবিনের পাশে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে সন্তানটিকে ফেলে দেয়।
—‘আমি কী করলাম...’
—‘ক্ষমা করিস, মা হতে চেয়ে পারলাম না। তোকে সমাজে দেখাতে পারি না...’
কাঁদতে কাঁদতে সে পালিয়ে যায়। কে যেন এক টোকাই ছেলে তখন কাঁথা জড়ানো বাচ্চার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তার নাম শ্যামল। সে-ই ছেলে বাচ্চাটাকে কোলে তুল নেয়। ময়লার পাশে পড়ে থাকা এক আশ্চর্য উপহার। বয়স মাত্র ১৫, বস্তিতে বড় হয়েছে, রেললাইনের পাশে ঘুমায়। বাচ্চাটাকে দেখে তার নিজের ছোট ভাইয়ের কথা মনে পড়ে যায়—যে একদিন ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে।
সে ছেলেটার নাম রাখে—নীল। নীল বড় হতে থাকে বস্তির মাটিতে, ট্রাকের হর্নে, বাসের ধাক্কায়, হকারের চিৎকারে। কিন্তু নীল ছিল অন্য রকম। পঁচা ডাস্টবিন থেকে উঠে আসা একটা মস্তিষ্ক। পুরনো গিটার বাজাতে শিখে নেয় অন্য এক টোকাইয়ের কাছ থেকে। রাস্তার কোণে গান গায়—
‘মা কোথায়? কেন আমায় ফেলে দিয়েছিলে?’
বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে এখন নীলের আঁকা গান। তার কণ্ঠ এখন সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল।
একদিন সায়মা, যিনি এখন নামকরা এক এনজিও কর্মী, এক রোডশো তে যান। সেখানে এক ছেলেকে গান গাইতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েন।
চোখে তার ছেলের মতো মুখ। বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে।
— ‘তোমার নাম’?
—‘নীল। আমি রাস্তার মানুষ’।
—‘তোমার মা-বাবা কে’?
—‘জানি না। আমাকে ডাস্টবিনে পাওয়া যায়। একজন টোকাই মানুষ করেছিল’।
সায়মা আর কিছু বলতে পারে না। কাঁপতে কাঁপতে ছেলের দিকে তাকিয়ে শুধু ফিসফিস করে বলে—
—‘আমি... আমি তোর মা... আমি সেই গর্ভ, যে তোকে রাখতে পারেনি’।
নীল কিছু বলে না। চোখে জল জমে। সে এগিয়ে গিয়ে সায়মার কাঁধে হাত রাখে।
—‘তুমি মা? মা কি সন্তান ফেলে দেয়?’
সায়মা মাটিতে বসে পড়ে। কান্না করে।
নীল পেছন ফিরে যায়। তার কণ্ঠে ভেসে আসে—
‘আমি রাস্তার মানুষ। আমায় খুঁজে পেও না। আমি এখন পুরো পৃথিবীর সন্তান।’
এই সংবাদটি শেয়ার করুন
অন্যান্য খবর

আশুরা: ত্যাগ ও শোকের মহিমান্বিত দিন
নিজস্ব প্রতিবেদক।।প্রতিবছর ১০ মহররম সারা বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায় ধর্মীয় শ্রদ্ধা ও ভাবগম্ভীর পরিবে...

বাংলাদেশ-জাপান অংশীদারত্ব জোরদারে প্রধান উপদেষ্টার আহ্বান
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিনিয়োগ, মৎস্য, রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা ও যুব উন্নয়...

সতর্ক সংকেতে ৮ জেলা, ৪ সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর সতর্কতা জারি
দেশের উপকূলীয় ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যেতে পারে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার বেগে ঝড়ো হা...

চলতি মাসের ১৩ জুলাইয়ের পর প্রকাশিত হবে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষ...
নিজস্ব প্রতিবেদকচলতি বছরের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশের জন্য অ...

মাধ্যমিক পাঠ্যপুস্তকে ভুল সংশোধনে উদ্যোগ, শিক্ষকদের প্রস্তাব...
নিজস্ব প্রতিবেদক।।ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে চিহ্নিত ভুল ও ত্রুটি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়ে...

কুমিল্লার মুরাদনগরে এগিয়ে আসেনি কেউ, কবর খুঁড়ছে গ্রাম পুলিশ
কুমিল্লার মুরাদনগরের কড়ইবাড়ি গ্রামে গণপিটুনিতে নিহত মা রোকসানা বেগম রুবি ও তার দুই সন্তান রাসেল ও জো...
