মোহাম্মদ আলাউদ্দিন।।কুমিল্লা থেকে নিয়মিত প্রকাশিত ও ব্যাপক জনপ্রিয় “দৈনিক আমাদের কুমিল্লা” ও “দৈনিক পূর্বাশা” নামের দুটি আঞ্চলিক পত্রিকার ঘোষণাপত্র বাতিলের ঘটনা যেন আরেকবার আমাদের দেশের গণমাধ্যমের অবস্থা ও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে ভাবনার অবকাশ তৈরি করলো। নিয়মিত জমা প্রদান না করার অযুহাতে ঢাকা চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের সুপারিশে কুমিল্লার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ আমিরুল কায়ছার গত ১০ আগস্ট ২০২৫ইং পত্রিকা দুটি বাতিলের ঘোষণা দেন। আইনগত দিক থেকে হয়তো এই সিদ্ধান্ত যথাযথ, কিন্তু এর পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক চাপ কিংবা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অবমাননা রয়েছে কি না? তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে!
এই দুটি পত্রিকা দেশের রাজধানী থেকে প্রকাশিত কোনো দৈনিক নয়; বরং কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত আঞ্চলিক সংবাদপত্র। আঞ্চলিক গণমাধ্যম বহুদিন ধরেই মূলধারার মিডিয়ায় উপেক্ষিত জনমানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে। তারা ছোট পরিসরে হলেও মাঠপর্যায়ের সত্য তুলে ধরার চেষ্টা করে। কিন্তু সেই কণ্ঠ আজও অব্যাহতভাবে অবদমন, নিয়ন্ত্রণ কিংবা নিষ্ক্রিয় করার প্রবণতার শিকার। প্রশ্ন উঠছে- এই পত্রিকা দুটি আদতেই কি নিয়মিত না থাকার কারণে বন্ধ হয়েছে, নাকি এদের কিছু প্রতিবেদন কিংবা অবস্থান কারো অনিষ্ট করেছে? যদি
নিয়মিত প্রকাশই বাতিলের একমাত্র কারণ হয়ে থাকে, তবে এমন অসংখ্য ছোট-মাঝারি সংবাদপত্র রয়েছে যেগুলো নিয়মিত প্রকাশিত হয় না, তবুও বছরের পর বছর ধরে তাদের ঘোষণাপত্র বহাল থাকে। তাহলে এই দুটিকেই বেছে নেওয়ার পেছনে কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে কি?
যে আইন অনুসারে এই দুটি পত্রিকার ঘোষণাপত্র বাতিল করা হয়েছে, সেটি হচ্ছে ‘ছাপাখানা ও প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধীকরণ) আইন, ১৯৭৩’। আইনটির ৯ নম্বর ধারায় বলা আছে- কোনো দৈনিক সংবাদপত্র যদি টানা তিন মাস প্রকাশিত না হয়, তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার ঘোষণাপত্র বাতিল হয়ে যাবে। একইসাথে, নিয়মিত চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরে কপি জমা না দিলে সেটাও বাতিলের কারণ হতে পারে।
তবে বাস্তবতা হলো, দেশের বহু পত্রিকাই এই নিয়ম পালন করে না। রাজধানী ও বড় শহরগুলোর বাইরেও অনেক সংবাদপত্র রয়েছে যেগুলো বছরের পর বছর ধরে অনিয়মিত। অথচ তারা বহাল তবিয়তে তাদের ঘোষণা বহাল রেখেছে। তাহলে প্রশ্ন হলো- এই আইন শুধু বিশেষ বিশেষ গণমাধ্যমের জন্য প্রয়োগ হচ্ছে কি না? গণমাধ্যম বিশ্লেষকদের মতে, এমন আইন বা বিধান যদি একতরফাভাবে প্রয়োগ করা হয়, কিংবা কোনো রাজনৈতিক পক্ষের স্বার্থে ব্যবহার করা হয়, তবে তা আইনের শাসন নয়, বরং আইনের অপপ্রয়োগ বলে বিবেচিত হবে। আর গণমাধ্যমের মুখ বন্ধ করতে আইনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করলে তা কেবল গণতন্ত্রের জন্যই নয়, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সুশাসনের জন্যও হুমকি।
বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে আঞ্চলিক বা জেলা পর্যায়ের পত্রিকার ভূমিকা অপরিসীম। তারা সেই জায়গা থেকে প্রতিবেদন করে, যেখান থেকে জাতীয় পত্রিকার পক্ষে নিয়মিত সংবাদ সংগ্রহ সম্ভব হয় না। বিশেষ করে দুর্নীতি, স্থানীয় রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নানা বিষয় তারা নিয়মিত তুলে আনে। কিন্তু এমন আঞ্চলিক গণমাধ্যম আজ টিকে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত লড়াই করছে। অনুদান নেই, বিজ্ঞাপন নেই, আর নেই প্রয়োজনীয় সরকারি স্বীকৃতি। এর উপর আবার প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ, নিয়ম-কানুনের জটিলতা, এবং রাজনৈতিক চাপের মুখে তারা প্রায় বিপন্ন এক অস্তিত্বে পরিণত হয়েছে।
“দৈনিক আমাদের কুমিল্লা” ও “দৈনিক পূর্বাশা”র ঘটনা সেই বড় সংকটেরই প্রতিচ্ছবি। যদি তারা সত্যিই নিয়মিত কপি জমা না দিয়ে থাকে, তাহলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আগে তাদের সতর্ক করা যেত। প্রয়োজনে সময়সীমা দিয়ে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া যেত। কিন্তু কোনো পূর্ব সতর্কতা ছাড়া হঠাৎ ঘোষণা বাতিল- এটি কেবল প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং এটিকে অনেকেই রাজনৈতিক বা মনস্তাত্ত্বিক চাপ প্রয়োগের অংশ হিসেবে দেখছেন।
সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, “প্রত্যেক নাগরিকের বাক-স্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকবে।” কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই স্বাধীনতা প্রায়ই প্রশাসনিক, রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক নানা বাধার মুখে পড়ে।
আজও সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে যায়, সাংবাদিকরা হয়রানির শিকার হন, অনলাইন পোর্টাল বন্ধ করে দেওয়া হয়, রিপোর্টারদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় কিংবা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে মামলা দেওয়া হয়। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়- সংবিধানের প্রদত্ত স্বাধীনতা কি কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ?
যদি রাষ্ট্র কোনো সংবাদপত্রকে শুধুমাত্র প্রশাসনিক অনিয়মের অজুহাতে বন্ধ করে দেয়, তবে সেটি একটি নজির হয়ে দাঁড়ায়। এই নজির ভবিষ্যতে আরো বেশি পত্রিকার ওপর প্রয়োগ হতে পারে। রাষ্ট্র যদি চায়, তবে অনিয়ম বন্ধ করার পাশাপাশি একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করেও সমাধান বের করতে পারে। মনে রাখতে হবে- গণমাধ্যম রাষ্ট্রের শত্রু নয়; বরং গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে রাষ্ট্রের দুর্বলতা ও অন্যায় তুলে ধরে তাকে আরো শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজ এই পেশাটিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন সাংবাদিকরা সমাজ বা রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজ করছেন। কিন্তু বাস্তবে সংবাদমাধ্যমের নিঃস্বার্থ কাজই সমাজে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার অন্যতম মাধ্যম।
আজ “আমাদের কুমিল্লা” ও “পূর্বাশা”র ঘোষণাপত্র বাতিল হলেও, কাল হয়তো অন্য কোনো পত্রিকার কণ্ঠ রুদ্ধ হবে। প্রশ্ন- শুধু পত্রিকা বন্ধ হওয়া নিয়ে নয়, বরং এর মধ্য দিয়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে- সেই মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। এখন সময় এসেছে খোলামেলা আলোচনার। প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, এবং গণমাধ্যমকর্মীদের বসে এই বিষয়ে একটি যৌথ সমাধানে পৌঁছাতে হবে। গণতন্ত্র কেবল নির্বাচনে সীমাবদ্ধ নয়; বরং সে বাঁচে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার চর্চায়।
এই প্রশ্নটি আমাদের এখনও তাড়া করে বেড়ায়- গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ বন্ধ হবে কবে? তার উত্তর খুঁজে পেতে হলে আগে স্বীকার করতে হবে যে, কণ্ঠরোধ এখনো বিদ্যমান। আর তারপর, সম্মিলিতভাবে গড়ে তুলতে হবে এমন এক গণতান্ত্রিক পরিবেশ, যেখানে কণ্ঠস্বর রুদ্ধ নয়, বরং প্রতিফলিত হয়।