প্রতিবেদক: Nayan Dewanji | ক্যাটেগরি: ফিচার ও মুক্ত চিন্তা | প্রকাশ: 5 Jun 2025, 10:49 PM
                                 
                        
                        আমার শৈশবটা কেটেছে কুমিল্লার এক প্রত্যন্ত গ্রামে, চারপাশে শস্যক্ষেত, পাখির ডাক, আর শান্ত দুপুরের হাওয়ায় ভেসে আসা আজানের সুরের মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে । কিন্তু সেই নিসর্গের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল ছিল মুসলমানদের দুইটি পবিত্র ইদ ।ইদুল ফিতর এবং ইদুল আযহা বা কোরবানির ইদ। সে ছিল এক আবেগময় উৎসব, যার কেন্দ্রস্থলে থাকত—একটি গরু, কিছু অপেক্ষা, আর এক ধরনের মিষ্টি কষ্ট।
সেই বছর আমাদের ঘরে এসেছিল এক অদ্ভুত শান্ত প্রকৃতির গরু। তার গায়ের রঙ ছিল লালচে মসৃণ ত্বক, চোখে যেন বিস্ময়ের গভীর ছায়া, আর আচরণে ছিল অদ্ভুত কোমলতা। আমরা তাকে নাম দিয়েছিলাম—“লালচান"।
"লালচান" এল ইদের পাঁচ দিন আগে। তার আগমনেই আমাদের উঠোনে নেমে এল আনন্দের জোয়ার। আমি, আমাদের ঘরের ছোট সদস্যরা, আর পাশের বাড়ির ছেলে মেয়ে আমরা বেশ কয়েকজন মিলে গরুটাকে নিয়ে মাতামাতি শুরু করলাম। তাকে প্রতিদিন গোসল করানো, খুঁটিতে বেঁধে ঘাস খাওয়ানো, শিংয়ে লাল-সবুজ ফিতা বাঁধা, গলায় ফুলের মালা ঝোলানো—সব কাজ যেন একটা উৎসবের অঙ্গ হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু যে আনন্দে মাতামাতি করতাম, সেই আনন্দেই এক ধরনের নীরব বিষণ্ণতা মিশে থাকত। কারণ আমরা জানতাম, এই গরুটি কেবল খেলার জন্য আসেনি, সে এসেছে বিদায়ের প্রস্তুতি নিয়ে।
ইদের আগের রাতে, চাঁদের আলোয় স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছিল আমাদের উঠোন। দূর থেকে ভেসে আসছিল মসজিদের মাইকে তাকবির। মা তখন সেমাই রান্না করছেন, বড় ভাইয়ের চোখে অদ্ভুত এক গাম্ভীর্য। আমি চুপচাপ গিয়ে লালচানের গায়ের পাশে বসেছিলাম। তার গা থেকে মাটি আর কাঁচা ঘাসের গন্ধ আসছিল। সে একবার আমার মুখের দিকে তাকাল, তারপর মাথা নামিয়ে নিল—যেন সব বুঝে গেছে।
ইদের দিন সকালবেলা চারদিকে মানুষের ব্যস্ততা, গায়ে নতুন জামা পরেছি বটে, কিন্তু মনটা ভারী হয়ে আছে। আমার বড় ভাইয়েরা নামাজ শেষে বাড়ি ফিরে বললেন, “আজ তোমাদেরও বড় হওয়ার দিন।” আমি বুঝিনি তখন, ঠিক কীসের বড় হওয়া।
গরু কোরবানির মুহূর্ত এল। উঠোনে লোকজন জড়ো হলো, কসাই এসে দাঁড়াল শান দেওয়া ছুরি হাতে। আমি দূরে দাঁড়িয়ে, ভাইয়ার হাত চেপে ধরে রাখতে মন চাইছে ।আমার মেজো ভাই মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। তাই ওনি নিজের গরু জবাই করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। আমার চোখে জল আসছিল, কিন্তু মুখ গম্ভীর। লালচানকে শোয়ানো হলো। সে প্রতিরোধ করল না। চুপচাপ শুয়ে রইল, মাথা নিচু, চোখে এক ধরনের নৈঃশব্দ্যের সমর্পণ।
সব হয়ে যাওয়ার পর আমি ছুটে গিয়ে মায়ের কোলে মুখ লুকানোর চেষ্টা করলাম পরক্ষণেই ভাবতে শুরু করলাম না ভেঙে পড়া যাবেনা। এটা সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির জন্য আমাদের ত্যাগ। তখনই মা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,“ত্যাগ মানে শুধু কাউকে হারানো নয়, বরং যার জন্য তুমি ত্যাগ করো, তার প্রতি তোমার ভালোবাসার গভীরতা মাপা যায় সেই ত্যাগে।”
জবাই করা গরুর মাংস কাটাকাটির সময়ে আমরা সবাই একসাথে গল্প করতে করতে হলুদ গুড়া বা চাউলের গুড়া হাতে নিয়ে বসে পড়ি দা -বটি নিয়ে।গরুর নানা অঙ্গ পতঙ্গ নিয়ে হতো চুলছেড়া বিশ্লেষণ।মগজ থেকে শুরু করে হার্ট ,যকৃত ,ফুসফুস এইসব নিয়ে। কাটাকুটির মাঝে কারোর কারোর হয়তো হাত কেটেই শেষ হতো। এক পর্যায়ে রান্নার জন্য ও কিছু মাংস চলে যেতো। ইদে একটা নিরব প্রতিযোগিতা চলতো পাশের বাড়ির আগে যেন গরুর মাংস রান্না শেষ হয়ে যায়।
দুপুরে রান্না হলো কোরবানির মাংস। সাথে চাউলের গুড়া দিয়ে বানানো রুটি তো আছেই ।আমি কিছুতেই মুখে তুলতে চাইছিলাম না। তখন মা এক টুকরো মাংস হাতে তুলে বললেন,
“এই টুকরোটা লালচানের। তার ভালোবাসা এখন তোমার ভেতরেই বেঁচে থাকবে।”আমি মাংসটা মুখে দিলাম—আর একটা অদ্ভুত বেদনার সঙ্গে বুকভরা তৃপ্তি অনুভব করলাম।
আজ, অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। এখন শহরের কর্মব্যস্ততায় ইদের ছুটি হয় দু-এক দিনের। গরুর সঙ্গে বন্ধুত্ব, উঠোনের তাকবির, কিংবা সেই লালচানের মতো গরুর চোখে তাকিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলার অনুভূতি—সবই এখন স্মৃতির খেয়ায় ভেসে বেড়ায়।
তবু, প্রতি কোরবানির ইদে যখন ভোরের তাকবির কানে আসে, আমি এখনো অনুভব করি—আমার শৈশবের সেই ইদের সকালে, একটি গরু আমার হৃদয়ে এক গভীর শিক্ষার বীজ বুনে দিয়েছিল। ভালোবাসা, দায়িত্ব আর ত্যাগ—এই তিনে গড়ে ওঠে ইদের প্রকৃত মাহাত্ম্য।
- কবি ও লেখক: খাজিনা খাজি
 - সাংগঠনিক সম্পাদক,
 - কুমিল্লা কবি পরিষদ
 
এই সংবাদটি শেয়ার করুন
অন্যান্য খবর
                                
                                কুমিল্লার মাঠে বিএনপির চূড়ান্ত দল সাজানো — যাদের ওপর ভরসা কর...
কুমিল্লার রাজনীতি আবার সরগরম। এক সময়ের রাজনৈতিক ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই জেলা এখন জাতীয় রাজনীতির আলোচন...
                                
                                কোতোয়ালির সন্তান অবশেষে সদর আসনে— বিএনপির টিকিট পেলেন মনিরুল...
দীর্ঘ রাজনৈতিক পথচলার পর অবশেষে স্বপ্নের আসনে ফিরলেন কুমিল্লার কোতোয়ালির সন্তান মনিরুল হক চৌধুরী। কু...
                                
                                কুমিল্লায় অস্ত্র ও গাঁজাসহ বিপুল জব্দ: বিজিবির অভিযানে দুই ব...
কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার ধনপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে দুইটি বিদেশি পিস্তল, দুই রাউন্ড গুলি, দুইটি...
                                
                                দক্ষতা বিকাশে বিদেশি ভাষা শেখার পরামর্শ দিলেন ড. সায়মা হক বি...
শিক্ষার্থীদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যেতে হলে অন্তত একটি বিদেশি ভাষায় দক্ষতা অর্জনের আহ্বান জানি...
                                
                                নেপালে পানবাড়ি পর্বতে নিখোঁজ দুই ইতালীয় পর্বতারোহী, তীব্র তু...
নেপালের পশ্চিমাঞ্চলের পানবাড়ি পর্বতে অভিযান চালানোর সময় দুই ইতালীয় পর্বতারোহী নিখোঁজ হয়েছেন। দেশটির...
                                
                                জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের জোর প্রস্তুতি: প্রশিক্ষণ ন...
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে সরকার সর্বাত...
                                
                                রায়পুরে চেয়ারম্যান কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল ও পুরষ্কার...
আখতার হোসাইন খানলক্ষ্মীপুর জেলা প্রতিনিধিলক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার প্রিন্সিপাল কাজী ফারুকী স্কুল এ...
                                
                                ভয় নয়, বিস্ময়! কুমিল্লায় ধরা পড়ল ১২ ফুট লম্বা অজগর সাপ
কুমিল্লার কোটবাড়ি এলাকায় হঠাৎ করেই দেখা মিলল এক বিশাল আকৃতির অজগরের! শনিবার সকালে আনসার ক্যাম্পের পা...
                                
                                নির্বাচনের আগেই নতুন বই শিক্ষার্থীদের হাতে: প্রাথমিক শিক্ষা...
আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সামনে থাকলেও নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই পৌঁছে দিতে কোন...
                                
                                কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের নতুন নেতৃত্ব গঠনে তিন সদস্...
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের (ছাত্রদল) নতুন কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সংগঠন...
                                
                                রাশিয়ার ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইউক্রেনে ২ শিশুসহ ৬ জনের...
ইউক্রেনে আবারও রাশিয়ার তীব্র হামলা। শনিবার গভীর রাত থেকে রোববার ভোর পর্যন্ত চলা একের পর এক ড্রোন ও ক...
                                
                                সারাদেশে ক্যান্সার সচেতনতা বাড়াতে প্রধান উপদেষ্টার আহ্বান
বাংলাদেশে ক্যান্সারসহ অন্যান্য অ-সংক্রামক রোগ নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্...