
প্রতিবেদক: Nayan Dewanji | ক্যাটেগরি: ভ্রমণ | প্রকাশ: 4 Jul 2025, 11:22 PM



বাংলাদেশের অজস্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে কিছু কিছু স্থান থাকে, যেগুলো শুধুই চোখে দেখার জন্য নয়—বরং অনুভব করার জন্য। তেমনই এক নিসর্গজ খাঁটি সৌন্দর্যের নাম নীলাদ্রি লেক। এই লেক যেন এক অলৌকিক নীল জলের আয়না, যেখানে আকাশ নিজেকে প্রতিফলিত করে। একপাশে মেঘালয়ের সবুজ পাহাড়, আর চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ছড়া, পাথর আর চুনাপাথরের পরিত্যক্ত খনি—সব মিলে এক অপরূপ ভ্রমণ অভিজ্ঞতা।
কোথায় এই নীল রহস্য?
নীলাদ্রি লেক অবস্থিত সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার সীমান্তঘেঁষা গ্রাম টেকেরঘাটে। মেঘালয়ের পাহাড় নেমে এসেছে প্রায় লেকের কিনারে এসে থেমে গেছে। যাকে দেখে মনে হয়, যেন কোনো দৈত্যাকার শিল্পী তার রঙতুলিতে নীল রঙে আঁকছে একটা জলজ সিম্ফনি।
এই লেকের প্রকৃত নাম শহীদ সিরাজ লেক, কিন্তু স্থানীয়দের কাছে পরিচিত “টেকেরঘাট পাথর কোয়ারি” নামে। আর ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে এর সৌন্দর্য এমন গভীর রেখাপাত করেছে যে, তারা একে আদর করে ডাকছে “বাংলার কাশ্মির” নামে।
কেমন এই লেকের সৌন্দর্য?
নীলাদ্রি লেকে দাঁড়িয়ে প্রথমে যা চোখে পড়ে তা হলো পানির অস্বাভাবিক নীলাভ রঙ। এই রঙ প্রকৃতির, কোনো রঙচক্র বা ফিল্টারের নয়। প্রকৃতির খেয়ালে এই পানি কখনো গাঢ় নীল, কখনো হালকা ফিরোজা, কখনো আবার ধূসর সবুজ ছায়া হয়ে ওঠে।
পাশেই পাহাড়, তার গায়ে ঝুলে থাকা মেঘ। আকাশ থেকে মাঝে মাঝে নেমে আসে সূর্যের ফোঁটা, পানির গায়ে পড়ে চকচক করে। চারপাশে নেই কোনো কোলাহল, নেই অতিরিক্ত দালান-কোঠা, নেই কৃত্রিম সাজসজ্জা। এখানে সময় যেন ধীর হয়ে যায়, শব্দ হয় নীরব, অনুভূতি হয় সজীব।
লেকের আশেপাশে আরও কী?
নীলাদ্রি লেকের চারপাশে এমন সব প্রাকৃতিক এবং কল্পনাজাগানিয়া জায়গা আছে যেগুলো একেকটা মিনি অ্যাডভেঞ্চার বলে মনে হবে। যেমন—
-
যাদুকাটা নদী: বিশাল পাথরের চরে দাঁড়িয়ে স্রোতের আওয়াজে মন হারিয়ে যাবে।
-
শিমুল বাগান: ফেব্রুয়ারিতে গেলে পুরো বাগান রক্তিম শিমুলে রাঙা হয়ে ওঠে।
-
বারিক্কা টিলা, লাকমাছড়া, টাঙ্গুয়ার হাওর: সবগুলোতেই আছে বিচিত্রতা, প্রাণ আর রোমাঞ্চ।
বর্ষায় গেলে এই অঞ্চল হয়ে ওঠে এক ভাসমান স্বর্গ, আর শীতে এটি হয়ে ওঠে পাখিদের অভয়ারণ্য।
বর্ষায় নীলাদ্রি: নীলিমার জীবন্ত চিত্রকল্প
বর্ষাকালেই নীলাদ্রি লেক সবচেয়ে বেশি মোহনীয় হয়ে ওঠে। তখন মেঘ ছুঁয়ে থাকে পাহাড়ের মাথা, পানির মধ্যে পড়ে রোদের সোনা ঝরে। আকাশ কাঁদে, আর সেই কান্না মিশে যায় লেকের জলে। রোদ-বৃষ্টি-মেঘ—সব মিলিয়ে এক দুর্দান্ত প্রাকৃতিক নাটক যেন মঞ্চায়িত হয় এখানে।
বর্ষাকালে আপনি চাইলে তাহিরপুর হয়ে নৌকায় টাঙ্গুয়ার হাওর পার হয়ে লেক পর্যন্ত যেতে পারেন। এই পথ ভ্রমণের রোমাঞ্চ আর সৌন্দর্য বলে বোঝানো যাবে না—তাকে শুধু অনুভব করা যায়।
থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা
নীলাদ্রি লেক এলাকাটি তুলনামূলক প্রত্যন্ত হওয়ায় এখানে খুব উন্নত মানের হোটেল নেই। তবে বড়ছড়া বাজার ও তাহিরপুর বাজারে রয়েছে কিছু গেস্ট হাউজ ও সাধারণ মানের হোটেল।
খাবারের জন্য কাছাকাছি বাজারে বেশ কিছু মোটামুটি ভালো মানের দোকান আছে, তবে মানসম্মত খাবারের জন্য সুনামগঞ্জ শহরে যাওয়া ভালো। বর্ষার সময় আপনি চাইলে বোটেই থাকার ও খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন, শুধু বাজারটা আগে করে নিতে হবে।
একটা দিনের পরিকল্পনা (যারা সময় কম পাবেন)
-
ভোর ৫টায় সুনামগঞ্জ পৌঁছান (রাতের বাসে)
সকাল ৭টায় মোটরসাইকেলে রওনা দিন টেকেরঘাটের পথে
৯টায় পৌঁছাবেন নীলাদ্রি লেকে
৯টা–১১টা: লেকে সময় কাটান, ছবি তুলুন, প্রকৃতি উপভোগ করুন
১১টা–১টা: যাদুকাটা নদী ঘুরে দেখুন
দুপুরে বাজারে খাবার খান
৩টায় রওনা দিন সুনামগঞ্জ শহরের পথে
সন্ধ্যায় আবার ঢাকাগামী বাস ধরুন
কিছু প্রয়োজনীয় টিপস
-
লাইফ জ্যাকেট ছাড়া পানিতে নামা ঝুঁকিপূর্ণ। সাঁতার না জানলে একদমই না।
-
নদী বা হাওরের স্রোত দেখতে সহজ মনে হলেও অনেক জায়গায় গভীরতা হঠাৎ বাড়ে।
-
পরিবেশদূষণ করবেন না। প্লাস্টিক ফেলা থেকে বিরত থাকুন।
-
স্থানীয়দের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলুন—তারা অনেক সাহায্য করে।
কিভাবে যাবেন ঢাকা ও কুমিল্লা থেকে?
ঢাকা থেকে নীলাদ্রি লেক:
১. বাসে সুনামগঞ্জ:
-
ঢাকার সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল বা মহাখালী থেকে সরাসরি এনা, শ্যামলী, মামুন পরিবহন এর বাস চলে।
-
সময় লাগে ৫.৫–৬ ঘণ্টা।
-
ভাড়া: প্রায় ৫৫০ টাকা।
২. সুনামগঞ্জ থেকে টেকেরঘাট:
-
সুরমা ব্রিজ এলাকা থেকে মোটরসাইকেলে (ভাড়া ৩০০–৪৫০ টাকা) টেকেরঘাট হয়ে নীলাদ্রি লেকে পৌঁছানো যায়।
-
বর্ষায় চাইলে তাহিরপুর হয়ে নৌকায় টাঙ্গুয়ার হাওর পেরিয়ে লেকেও যেতে পারেন।
কুমিল্লা থেকে নীলাদ্রি লেক:
১. কুমিল্লা → সিলেট → সুনামগঞ্জ রুটে:
-
কুমিল্লা থেকে ট্রেনে বা বাসে সিলেট (৩.৫–৪ ঘণ্টা), তারপর সিলেট থেকে সুনামগঞ্জে লোকাল বাস বা মাইক্রো।
-
সুনামগঞ্জ থেকে আগের মতো মোটরসাইকেলে বা নৌকায় টেকেরঘাট।
২. বিকল্প: কুমিল্লা → ঢাকা → সুনামগঞ্জ (রাতের বাস):
-
কুমিল্লা থেকে সন্ধ্যায় ঢাকায় গিয়ে রাত ১১টার বাস ধরে সুনামগঞ্জ পৌঁছানো যায়।
কোথায় থাকবেন?
-
তাহিরপুর বাজারে ২টি হোটেল এবং বড়ছড়া বাজারে কিছু গেস্ট হাউজ রয়েছে।
-
বর্ষায় গেলে বোটেই থাকা যায়, যেখানে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা একসাথে পাওয়া যায়।
-
আর উন্নত মানের হোটেলের জন্য সুনামগঞ্জ শহরেই থাকতে হবে।
-
-
কেন যাবেন নীলাদ্রি?
নীলাদ্রি লেক কোনো কৃত্রিম পর্যটন কেন্দ্র নয়। এখানে নেই গাইডেড ট্যুর, থিম পার্ক, বা বিলবোর্ডে মোড়ানো শহুরে হাতছানি। এখানে আছে নিঃসঙ্গতা, প্রকৃতি, নীরবতা আর নীলিমার বন্ধুত্ব। এখানে গিয়ে আপনি নিজেকে নতুন করে চিনবেন, প্রকৃতিকে আবারও ভালোবাসতে শিখবেন।
জীবনের ব্যস্ততা থেকে যদি খানিক সময় চুরি করতে চান, মনটাকে যদি একটুখানি শান্তি দিতে চান—তাহলে নীলাদ্রি লেক হোক আপনার পরবর্তী গন্তব্য।
লেখকঃনয়ন দেওয়ানজী
এই সংবাদটি শেয়ার করুন
অন্যান্য খবর

আশুরা: ত্যাগ ও শোকের মহিমান্বিত দিন
নিজস্ব প্রতিবেদক।।প্রতিবছর ১০ মহররম সারা বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায় ধর্মীয় শ্রদ্ধা ও ভাবগম্ভীর পরিবে...

বাংলাদেশ-জাপান অংশীদারত্ব জোরদারে প্রধান উপদেষ্টার আহ্বান
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিনিয়োগ, মৎস্য, রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা ও যুব উন্নয়...

সতর্ক সংকেতে ৮ জেলা, ৪ সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর সতর্কতা জারি
দেশের উপকূলীয় ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যেতে পারে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার বেগে ঝড়ো হা...

চলতি মাসের ১৩ জুলাইয়ের পর প্রকাশিত হবে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষ...
নিজস্ব প্রতিবেদকচলতি বছরের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশের জন্য অ...

মাধ্যমিক পাঠ্যপুস্তকে ভুল সংশোধনে উদ্যোগ, শিক্ষকদের প্রস্তাব...
নিজস্ব প্রতিবেদক।।ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে চিহ্নিত ভুল ও ত্রুটি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়ে...

কুমিল্লার মুরাদনগরে এগিয়ে আসেনি কেউ, কবর খুঁড়ছে গ্রাম পুলিশ
কুমিল্লার মুরাদনগরের কড়ইবাড়ি গ্রামে গণপিটুনিতে নিহত মা রোকসানা বেগম রুবি ও তার দুই সন্তান রাসেল ও জো...
