বাংলা নারী জাগরণের ইতিহাসে এক দীপ্তিমান নাম—নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী। ১৮৩৪ সালে কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার পশ্চিমগাঁ গ্রামে জন্ম নেওয়া এই মহীয়সী নারী শুধু জমিদারই নন, ছিলেন সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাব্রতী, সাহিত্যিক এবং এক দূরদর্শী নেতৃত্বের প্রতীক।
ব্রিটিশ ভারতে, নারী যখন অন্তরালেই সীমাবদ্ধ, তখনই ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ভেঙেছেন সামাজিক প্রথার দেয়াল। ছোটবেলা থেকেই পারিবারিক শিক্ষকের সহায়তায় বাংলা, আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করেন। লেখাপড়ার প্রতি অদম্য আগ্রহ ছিল তাঁর।
১৮৬০ সালে জমিদার সৈয়দ মোহাম্মদ গাজীর সঙ্গে বিয়ে হলেও দাম্পত্য জীবনে মিল না থাকায় বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর থেকেই সমাজসেবা ও নারীশিক্ষা বিস্তারে নিজেকে নিবেদন করেন।
নারী শিক্ষায় তাঁর অবদান অনন্য। ১৮৭৩ সালে কুমিল্লায় প্রতিষ্ঠা করেন বালিকা বিদ্যালয়—যা আজকের নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। শুধু তাই নয়, মেয়েদের জন্য হোস্টেল, বৃত্তি, স্বাস্থ্যসেবা, এমনকি জানানা হাসপাতালও স্থাপন করেন। তিনি ছিলেন সাহসী, দূরদর্শী ও অকুতোভয়।
লেখালেখিতেও ছিল তাঁর সরব উপস্থিতি। ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘রূপজালাল’, যা নারী সাহিত্যিকদের জন্য পথিকৃত স্বরূপ।
১৮৮৯ সালে ব্রিটিশ রানি ভিক্টোরিয়া তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে 'নওয়াব' উপাধিতে ভূষিত করেন—যা দক্ষিণ এশিয়ায় কোনো নারীর জন্য প্রথম এবং একমাত্র ঘটনা।
১৯০৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পরপারে পাড়ি জমান এই মহান নারী। মৃত্যুর পরও তাঁর রেখে যাওয়া প্রতিষ্ঠান ও আদর্শ যুগ যুগ ধরে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে চলেছে।
২০০৪ সালে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁর নামে ছাত্রী হল স্থাপন করা হয়েছে—যা তাঁর প্রতি জাতির গভীর শ্রদ্ধার নিদর্শন।
নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছিলেন না শুধুই একজন জমিদার কিংবা শিক্ষানুরাগী; তিনি ছিলেন এক জনপদের আলোকবর্তিকা, যাঁর আলো আজও দীপ্তিময়।